নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব ৪

 

আগের পর্ব 

সময় নদীর মতো বয়ে যায়। সারাদিন পড়াশোনায় ডুবে ছিল অয়ন। চায়ের সেই ছোট্ট বিরতির বাইরে তেমন কথাবার্তা হয়নি। সঙ্গীতা নিজেও ব্যস্ত ছিল ঘরের কাজে। আগে তো সারাদিন একাই থাকত, খেতে মন চাইলে খেয়েছে, না চাইলে উপোস থেকেছে। এখন তো আর একা নয়, অয়ন এসেছে—তাকে তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না। তাই সকালেই রান্নার কাজে নেমে পড়ে সে।


রান্না করতে করতেই মনে পড়ে, যদি একটা প্রেম করা যেত! সত্যিই তো, ওতো প্রেম বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। যদি কখনো প্রেম করত, তবে সেই মানুষটা কেমন হতো? ওকে কেমন ভালোবাসত? ওর জন্য কি পাগলামি করত? কি ঝগড়া করত? ক্লাস মিস দিয়ে কি ঘুরতে বের হতো? সারারাত কথা বলত? এসব ভাবতেই মনটা ভার হয়ে আসে। যেখানে স্কুল পেরোনো ছেলেমেয়েরা প্রেম করছে, সেখানে সে বাবা-মায়ের কথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল। এখন এসব ভাবলে মন খারাপ হয়, তাই ভাবনাগুলোকে দূরে ঠেলে দেয় সঙ্গীতা। কিন্তু অয়নের সেই ‘ভালোবাসা’ কথাটাই বারবার মনে পড়ে যায়।


প্রথম দেখায় অয়নকে একেবারে বাচ্চা ছেলে মনে হয়েছিল। কিন্তু না, ছেলেটা খুবই ম্যাচিউরড আর বুদ্ধিমান। সুন্দর করে কথা বলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ওর চোখে সঙ্গীতার জন্য মুগ্ধতা দেখা যায়, যেখানে অন্য অনেক পুরুষের চোখে সে দেখেছে কেবল লালসা। বাইরে গেলে নিজেকে ওড়নায় ঢেকে বের হয়, কারণ কিছু মানুষের দৃষ্টি কেবল লালসাতেই আটকে থাকে। কিন্তু অয়ন আলাদা।


রান্না শেষ হতেই সঙ্গীতা ডাক দিল,


“অয়ন, স্নান করে নাও, খেতে দিচ্ছি।”


“আচ্ছা,” বলে উঠে যায় অয়ন।


সঙ্গীতা এই ফাঁকে কিছু কাপড় ধুয়ে নেয়। কিন্তু বারান্দায় জায়গা নেই, অয়নের বারান্দাটা খালি দেখে ওখানেই কাপড় মেলে দেয়। তখনই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অয়ন, গায়ে শুধু একটা তোয়ালে, শরীরের পানি গড়িয়ে পড়ছে। পেটানো শরীর দেখে সঙ্গীতা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নেয়। ইসস! এটা কী দেখল! অয়নও বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজা লাগানোর শব্দে সঙ্গীতা চোখ খুলে হাসতে শুরু করল। ছেলেটা যে এত লজ্জা পেতে পারে, ভাবতেই ভালো লাগল। যাওয়ার আগে বাথরুমের দরজার সামনে এসে বলল,


“আমি চলে যাচ্ছি, তুমি কাপড় পরে এসো, খেতে দিচ্ছি।”


ভেতর থেকে অয়ন বলল, “আচ্ছা।”


খাবার টেবিলে এসে বসলো অয়ন। সঙ্গীতা ওর সামনে খাবার পরিবেশন করল। যখন নিজের খাবার নিতে এলো, তখন অয়নের নাকে এক মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগল। এই ঘ্রাণ সঙ্গীতার শরীর থেকে আসছে। অয়নের মনে হলো, সারাদিন যদি এই ঘ্রাণ নিতে পারত, তাহলে বড্ড ভালো হতো। এর চেয়ে সুন্দর ঘ্রাণ হয়তো আর কিছুতেই নেই…।



মিষ্টি মুহূর্ত


অয়ন খাওয়ার সময় বেশ লজ্জা পেতে শুরু করল। সঙ্গীতার দিকে তাকাতেও পারছে না, আর সেটা সঙ্গীতা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। মুচকি হেসে বলল,


“কি দেবর মশাই, আগে কখনো কোনো মেয়ের সামনে কাপড় খুলে যাওনি নাকি? এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?”


সঙ্গে সঙ্গে অয়নের কান লাল হয়ে গেল। ওর ত্বক ফর্সা হওয়ায় সেটা আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অয়ন মুখ গম্ভীর করে বলল,


“নাহ, কেনই বা কাপড় খোলা লাগবে?”


“আরে, কত কারণেই তো যেতে হতে পারে!”


“আমি তো কোনো কারণ দেখছি না।”


“কেন? রাতের কাজের জন্যও তো কাপড় খুলতে হয়!”


সঙ্গীতার কথা শুনে অয়ন চোখ ছোট করে তার দিকে তাকাল। ও বুঝতে পারল না, ‘রাতের কাজ’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছে বৌদি। সঙ্গীতা মিটিমিটি হাসছে, যেন ওর প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় আছে। কয়েক মুহূর্ত পর অয়নের মাথায় এল ব্যাপারটা, আর সঙ্গে সঙ্গে আরও লজ্জায় পড়ে গেল।


“ধুর, বৌদি! কী সব বলছ! আমি এসব করব কেন?”


“কেন? পারো না নাকি?”


এই বলে সঙ্গীতা জোরে হেসে উঠল।


অয়ন বুঝল, না, বৌদি সহজে থামবে না। তাই সে অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনল।


“বৌদি, খাও তো, আর আমাকেও খেতে দাও! আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”


সঙ্গীতা হাসতে হাসতে খাওয়ায় মন দিল। অনেকদিন পর এত প্রাণ খুলে হাসল সে। আর অয়ন? একবার চোখ তুলে তাকানোর পর পুরো খাবারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর সঙ্গীতার দিকে তাকায়ইনি!


খাওয়ার পর সঙ্গীতা প্লেট ধুয়ে নিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারাদিনের কাজের পর এখন একটু নিজের সময়। সে প্রাতিলিপি খুলল, যেখানে অর্ক আহমেদ নামে এক বাংলাদেশি লেখকের নতুন গল্পের পর্ব বেরিয়েছে— “মিষ্টি মুহূর্ত”।


গল্পটা পড়তে পড়তে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল, দেখল বিকেল হয়ে গেছে।


“উফ! আর শুয়ে থাকা যাবে না!”


সে উঠে ঘরের কাজগুলো সারতে লাগল। বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে নিয়ে রাখল, তারপর চা বানাল। নিজের জন্য, আর অয়নের জন্যও।


অয়নের ঘরে গিয়ে দেখল, ও এখনো ঘুমিয়ে আছে। ধীরে ধীরে ডাক দিল,


“অয়ন, ওঠো! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে!”


অয়ন ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যাকে দেখল, সে তার স্বপ্নের নারী—সঙ্গীতা। মনটা মুহূর্তেই ফুরফুরে হয়ে গেল।


“একটু বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”


ফ্রেশ হয়ে এসে চায়ের কাপে চুমুক দিল অয়ন। আজও চায়ের প্রশংসা না করে থাকতে পারল না।


“বৌদি, তোমার চায়ের স্বাদ অসাধারণ! যে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলের চায়ের চেয়ে ভালো!”


“হয়েছে, আর বলতে হবে না!” সঙ্গীতা হেসে বলল, “আগে বলো, সত্যিই কি কখনো কোনো মেয়ের সামনে কাপড় খোলোনি?”


অয়ন মাথা নিচু করল।


“শুনতেই হবে?”


“কেন? বন্ধুর সঙ্গে কি এসব কথা বলা যায় না?”


অয়ন চুপচাপ আরেকটা চুমুক দিল। তারপর বলল,


“সত্যি বলতে, না, কখনো না।”


সঙ্গীতা একটু অবাক হলো।


“কি বলছ! তোমার বয়সী ছেলেরা তো প্রেমের কয়েক মাসের মধ্যেই এসব শুরু করে দেয়!”


অয়ন এবার চোখে চোখ রেখে বলল,


“হুম, সেটা সত্যি। কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা একটু আলাদা। আমি আগে মন চাই। শরীর তো টাকায়ও পাওয়া যায়, কিন্তু মন পাওয়া যায় না। তাই আগে যদি মন পাই, শরীর পরে আপনাতেই মিলবে।”


সঙ্গীতা একটু ভাবল, তারপর প্রশ্ন করল,


“আচ্ছা, ভালবাসাই কি সব? মানে, মন পাওয়াটাই কি সব?”


অয়ন আবারও চায়ে চুমুক দিল।


“হ্যাঁ, মন পাওয়াই সব। কিন্তু ভালবাসার পূর্ণতা আসে মন আর দেহের মিলনে।”


সঙ্গীতা এবার সত্যিই কৌতূহলী হলো।


“মানে?”


“মানে, তুমি কাউকে ভালবাসো, সেও তোমাকে ভালবাসে—এতে ভালবাসার অর্ধেক পূরণ হলো। কিন্তু ভালবাসার পরিপূর্ণতা আসে দেহের একাত্মতার মাধ্যমে। আমি বলছি না, শরীরই সব। কিন্তু যাকে তুমি মন থেকে ভালবাসো, তাকে অনুভব করার সবচেয়ে সুন্দর উপায়ই হলো এই মিলন।”


সঙ্গীতা চুপ হয়ে গেল।


“তাহলে কি ভালবাসার ক্ষেত্রেও শরীর জরুরি?”


অয়ন মাথা নেড়ে বলল,


“অবশ্যই! ধরো, একটা মেয়ে কোনো ছেলেকে দেখতে গেল, আর দেখল ছেলেটার একটা অঙ্গ নেই—তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে ভেঙে যায়। কেন? কারণ শরীরটাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি আগে মন চাই, শরীর সবার শেষে পেলেও চলবে।”


সঙ্গীতা এবার মুগ্ধ হয়ে গেল।


“তাহলে তোমার কাছে সুখ মানে কী?”


অয়ন মৃদু হাসল।


“সুখ মানে? ভালবাসার মানুষ যখন হাসবে, তার সেই হাসিটাই আমার সুখ। সে যখন আমার সামনে শাড়ি পরে আসবে, আর আমি তাকিয়ে মুগ্ধ হবো—সেটাই সুখ। সে যখন আমাকে ভালোবাসবে, আমি তার দিকে তাকিয়ে হার্টবিট মিস করব—সেটাই সুখ। তাই দেহ না হয় পরে পেলাম, কিন্তু মানুষটা যেন শুধু আমার হয়, শুধু আমার!”


সঙ্গীতা মন দিয়ে শুনল সব কথা।


এত গভীরভাবে কেউ কখনো তাকে এভাবে বলেনি। ভালবাসা নিয়ে এই ছেলেটার উপলব্ধি তাকে বারবার মুগ্ধ করছে।


আজ আর কিছু বলতে পারল না সে। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অয়নের দিকে।



অয়ন বলল


“কি গো কি ভাবছো?”


অয়নের কথায় সঙ্গীতার ঘোর ভাঙ্গে আর বলে,


“না কিছু না। ”


“তুমি পড় এখন। চায়ের কাপ এখানেই রেখ আমি এসে পড়ে নিয়ে যাব।”


বলে সঙ্গীতা চলে গেল।আর অয়ন দেখতে লাগল প্রস্থান।


চলবে

Post a Comment

Previous Post Next Post