নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব ৩

 

আগের পর্ব 

অয়নের কলকাতায় তৃতীয় দিন। খুব বেশি খারাপ লাগছে না, তবে খুব একটা ভালোও লাগছে না। একটা অদ্ভুত দম বন্ধ করা অনুভূতি কাজ করছে তার মধ্যে। সারাদিন গ্রাম চষে বেড়ানো একটা ছেলের পক্ষে কি ঘরের মধ্যে বন্দি থাকা সম্ভব? কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য এটুকু করতেই হবে।


তার সাথে এসেছে প্রিয় কিছু উপন্যাস আর কবিতার বই। সময় যেন কাটতেই চায় না, তখন সে বই খুলে বসে। এখন ঘরে শুধু সে আর সঙ্গীতা। চারপাশ এতটাই নিরব যে কেউ যদি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়, বুঝতেই পারবে না ঘরে কেউ আছে।


অয়ন ডুবে আছে বইয়ের জগতে। কৌশিক মজুমদারের ডিটেকটিভ সিরিজটা পড়ছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো এক নারীকণ্ঠ—


“আসল পড়া বাদ দিয়ে এই সময় উপন্যাস পড়া হচ্ছে?”


অয়নের চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! এত মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো যে, আচমকা এই কণ্ঠ শুনে যেন হার্টবিট এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। চোখ মুখে ভয়টা স্পষ্ট।


সঙ্গীতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এত জোরে হাসছে যে হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ল।


অয়ন কিছুই বলতে পারল না, শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। কাউকে হাসলে এত সুন্দর দেখায়, সেটা হয়তো সঙ্গীতার হাসি না দেখলে জানা হতো না।


অনেকক্ষণ হাসার পর সঙ্গীতা বলল,

“সরি, আমি বুঝতে পারিনি তুমি এত ভয় পেয়ে যাবে। আমি শুধু দেখতে দেখতে এসেছিলাম।”


অয়ন ভেবেছিল রাগ দেখাবে, কিছুটা তেতো কথা শোনাবে, কিন্তু সঙ্গীতার হাসি দেখার পর যেন সব ভুলে গেল। শুধু বলল,

“এভাবে ভয় না দেখালেও পারতে। আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।”


এই কথা শুনে আবার হাসতে লাগল সঙ্গীতা।

“ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না, আর এমন হবে না। কিন্তু তোমার তো এখন পড়ার কথা, তুমি সেখানে উপন্যাস পড়ছো কেন?”


“আসলে খুব বোরিং লাগছিলো। কিছু করার ছিল না, তাই ভাবলাম একটু বই পড়ি।”


“তা তোমার বোরিং লাগলে তোমার গার্লফ্রেন্ডকে তো কল দিয়ে কথা বলতে পারতে!”


অয়ন হালকা হাসল, “আমার তো গার্লফ্রেন্ড নেই।”


সঙ্গীতা একটু অবাক হলো।


ছেলেটা দেখতে হ্যান্ডসাম, বয়সের তুলনায় অনেকটাই ম্যাচিওর, এমন একজনের একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই? ভাবতেই পারে না সঙ্গীতা।


“স্ট্রেঞ্জ! আমি তো ভেবেছিলাম তোমার অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে!”


অয়নও হেসে দিল।


সঙ্গীতা এই প্রথম অয়নের হাসি দেখল। মনে হলো, “নাহ, ছেলেটার হাসি বড্ড সুন্দর!”


অয়ন হাসি থামিয়ে বলল,

“প্রেম প্রস্তাব কম পাইনি, কিন্তু কখনো ইচ্ছে হয়নি।”


“কেন?”


“কারণ আমি প্রেম করতে চাই না, আমি ভালোবাসতে চাই।”


সঙ্গীতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা, প্রেম আর ভালোবাসা কি আলাদা?”


“অবশ্যই আলাদা।”


“কীভাবে?”


অয়ন একটু থেমে বলল,


“প্রেম হলো একটা সম্পর্কের নাম, আর ভালোবাসা একটা অনুভূতি। জরুরি নয়, তুমি যাকে ভালোবাসছো তার সঙ্গে তোমার প্রেম হবে। আবার তুমি যার সঙ্গে প্রেম করছো, সেখানে ভালোবাসা নাও থাকতে পারে।”


সঙ্গীতা কোনো উত্তর দিল না। শুধু চুপচাপ বসে রইল। কথাগুলো ওর মনে দাগ কেটে গেল।


অয়ন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সঙ্গীতা হাসতে হাসতে বলল,

“তাহলে তুমি কি করতে চাও?”


অয়ন চোখের সামনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে তাকিয়ে বলল,

“আমি ভালোবাসতে চাই, প্রেমও করতে চাই। আমার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে একটু সুখের মুহূর্ত কাটাতে চাই।”


সঙ্গীতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,

“তা তুমি কি পেয়েছো তোমার ভালোবাসার মানুষকে?”


অয়ন মৃদু হাসল, “পেয়েছি কিনা, সেটা বলতে পারব না।”


“আমাকে তো বলতে পারো?”


“আচ্ছা, সময় আসুক, বলব।”


সঙ্গীতা মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, বলবে, কিন্তু আমিও দেখতে চাই আমাদের অয়ন কাকে পছন্দ করে!”


অয়ন হেসে বলল, “ঠিক আছে, দেখো।”


সঙ্গীতা উঠে দাঁড়াল, “এখন তুমি উপন্যাস বাদ দিয়ে নিজের পড়াটা পড়ো, কারণ উপন্যাস তো পরেও পড়তে পারবে।”


অয়ন মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”


সঙ্গীতা দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি দুপুরের খাবার বানাতে যাচ্ছি। তোমাকে কি চা দিয়ে যাব?”


অয়ন হেসে বলল, “হ্যাঁ, দাও। কে না বলেছে!”


সঙ্গীতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, আর অয়ন চায়ের কাপে হাত রাখল। কিন্তু মন তার অন্য কোথাও।


“চাইলেই কি সব বলা যায়? আমি তো চাইলেও কখনো বলতে পারব না যে, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রতিদিন তোমাকে যখন দেখি, আমার মনের মধ্যে যে ঝড় শুরু হয়, তার কোনো শেষ নেই। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার বুকে যে ঝড় বয়ে চলেছে, তা অনন্তকাল ধরে চলবে। কিন্তু তুমি তো কখনো আমার হবে না, সঙ্গীতা।”


একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অয়ন চোখ বন্ধ করল।


সঙ্গীতা চা বানাতে বানাতে ভাবছিল, “আচ্ছা, সূর্যের মধ্যে কি সত্যিই প্রেম আছে? ভালোবাসা আছে কি? কখনো কি ও আমার জন্য কিছু করেছে, যা আমার পছন্দ? কখনো কি বলেছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’? না, কখনো বলেনি।”


বাইরে থেকে দেখলে সূর্য আর সঙ্গীতাকে পারফেক্ট কাপল মনে হয়। কিন্তু সত্যি বলতে, পারফেক্ট বলে কিছু হয় না। সূর্য তার নিজের কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর জন্য সময়ই নেই। ওর কোনো কিছুতেই বাধা নেই, যা দরকার সব দেয়, যত টাকা দরকার ভাঙিয়ে দেয়, কিন্তু টাকা তো সব নয়। এই কথাটা ওকে বোঝাবে কে?


ভাবতে ভাবতে চা বানিয়ে নিলো নিজের জন্য আর অয়নের জন্য।


অয়ন তখন নিজের পড়ায় ডুবে থাকার চেষ্টা করছিল।


সঙ্গীতা চায়ের কাপ রেখে বলল, “নাও, তোমার চা।”


অয়ন এক চুমুক দিয়ে বলল, “ইসস! বৌদি, যা চা বানিয়েছো, একেবারে ফার্স্ট ক্লাস!”


সঙ্গীতা হেসে ফেলল, “থ্যাংকস!”


অয়ন হেসে বলল, “তুমি যদি কিছু মনে না করো, তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”


সঙ্গীতা মাথা নাড়ল, “হুম, বলো?”


“তুমি কি বিয়ের আগে প্রেম করোনি?”


সঙ্গীতা হেসে বলল, “সুযোগ পেলাম কই? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কলেজে উঠতেই ছেলেদের সম্বন্ধ আসতে শুরু করল। যখন ভাবলাম প্রেম করব, তখন তো বিয়েটাই হয়ে গেল! আর প্রেম করা হলো কই?”


অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইসস! আমি যদি তোমার সমবয়সী হতাম, তাহলে নিশ্চিত প্রেম প্রস্তাব দিতাম!”


সঙ্গীতা হেসে কুটিকুটি, “এই বিবাহিত মহিলাকেই পছন্দ হলে বুঝি!”


অয়ন গম্ভীর মুখে বলল, “ধুর! তুমি কেন ‘মহিলা’ হবে?”


সঙ্গীতা ভ্রু কুঁচকে বলল, “মহিলাই তো?”


অয়ন মাথা নাড়ল, “না, তোমার হাতে শাখা-পলা আর সিঁথিতে সিঁদুর না দেখলে কেউ বুঝবেই না তুমি বিবাহিত।”


সঙ্গীতা একটু যেন মুচকি হাসল। সত্যিই, বিয়ের পর তার খুব বেশি বদল হয়নি। বাইরে থেকে তাকালে কেউ বুঝবেই না সে বিবাহিত। কিন্তু এই কথাগুলো শুনে ভালো লাগলেও, তাতে কিছু পরিবর্তন হবে না।


তাই বলল, “হয়েছে দেবর মশাই, এখন পড়ায় মন দাও। আগে পড়ো, পরে না হয় এইসব নিয়ে কথা হবে!”


অয়ন মজা করে বলল, “তা হবে, কিন্তু এক কথা মানতে হবে—তুমি বড্ড সুন্দরী। পুরো অপ্সরা!”


সঙ্গীতা হাসতে হাসতে বলল, “থ্যাংকস, দেবর মশাই! এখন তুমি পড়ো!”


এই বলে সঙ্গীতা চলে গেল, আর অয়ন তাকিয়ে রইল তার স্বপ্নের নারীর চলে যাওয়ার দিকে…

Post a Comment

Previous Post Next Post